ঢাকা ১১:১২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘কীই–বা অপরাধ করেছে যে ছেলেরে গুলি করে মারতে হইলো,’ প্রশ্ন মায়ের

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১২:২৬:২৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪
  • / 163
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনাটি বারবার মুঠোফোনে দেখছিল রাহাত হোসাইন (১৭)। এটি দেখে ভীষণ মন খারাপ করছিল সে। ১৭ জুলাই ভিডিওটি মা স্বপ্না আক্তারকে দেখিয়ে সে বলছিল, ‘দেখো, মা! পুলিশ ক্যামনে ছাত্রগোরে মারে।’ এর মাত্র এক দিন পর ১৮ জুলাই বিকেলে একই আন্দোলনে গিয়ে লাশ হয়ে ফেরে রাহাতও।

ঘটনাটি বর্ণনার এই পর্যায়ে আক্ষেপের সুরে স্বপ্না বলছিলেন, ‘ছেলে আন্দোলনে যাইবো, এইড্যা জানলে আমি কোনো দিনও ওরে হাতছাড়া করতাম না। জানলে নিজে লগে যাইতাম, গুলি খাইলে মা-ছেলে একলগেই খাইতাম।’

রাহাত হোসাইন উত্তরার নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। পোশাকশ্রমিক মা ও নানির সঙ্গে থাকত গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার গোপালপুরে। পরিবারের সচ্ছলতার জন্য বাবা পাড়ি জমিয়েছেন ভিনদেশে। রাহাতের পরিবারের দাবি, ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় সে।

মৃত্যুর ১১ দিন পর গত রোববার দুপুরে রাহাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাকে হারানোর শোকে কাতর পুরো পরিবার। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশাহারা মা স্বপ্না আক্তার। বাড়িতে গিয়ে নিজ ঘরেই পাওয়া গেল তাঁকে। দুই দিন আগে নিজেদের বাড়ি নরসিংদীতে রাহাতের দাফন শেষে আবার টঙ্গীতে ফিরেছেন। ছোট্ট ঘরটিতে একটি বিছানা, ওয়ার্ডরোব, পড়ার টেবিল আর কিছু দরকারি জিনিসপত্র। এসবের মধ্যে ছড়িয়ে আছে রাহাতের ব্যবহৃত বই-খাতা আর দেয়ালে কিছু কাপড় ও স্কুলব্যাগ। এগুলোর দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন স্বপ্না আক্তার। ছেলের কথা মনে পড়তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন।

আমার একটামাত্র ছেলে। ভাবছিলাম, একটারেই ঠিকমতো লেখাপড়া শিখাইয়্যা বড় করমু। সে আমাগোর অভাবের সংসারে হাল ধরব। কিন্তু এহন তো আমার সব শেষ! এহন আমি কই যামু।’ কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন নিহত রাহাতের মা।

রাহাতের বাড়িতে এই প্রতিবেদকের যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীরাও এক এক করে ভিড় জমান সেখানে। স্বপ্নাকে কাঁদতে দেখে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন কেউ কেউ, কেউ আবার নিজেরাও কাঁদছিলেন। এর মধ্যে এক প্রতিবেশী যুবক মুঠোফোনে রাহাতের লাশের ছবি বের করেন। এতে দেখা যায়, রাহাতের মাথার বাঁ পাশে গুলির ক্ষতচিহ্ন। পুরো মাথা ও শরীর রক্তে ভেজা। ওই অবস্থায় পড়ে আছে হাসপাতালের মেঝেতে।

প্রতিবেশীদের কয়েকজন বলেন, ১৮ জুলাই সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ তাঁরা খবর পান, রাহাত গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। তার মরদেহ পড়ে আছে উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। খবরটি শোনার পর অচেতন হয়ে পড়েন মা স্বপ্না। পরে প্রতিবেশীরাই উদ্যোগ নিয়ে রাহাতের মরদেহ আনার ব্যবস্থা করেন।

স্বপ্না মুঠোফোনটি নিজের হাতে নেন। ছবিটি দেখিয়ে বললেন, ‘এভাবে কেউ মানুষ মারে! ওর কী এমন বয়স হইসে, কীই–বা অপরাধ করেছে যে ছেলেরে গুলি করে মারতে হইলো? একটাবার দেহেন, মরার আগে আমার বাজানটার (ছেলে) কত কষ্ট হইসে। কষ্ট পাইবো দেইখ্যা নিজেরা কোনো দিন ওর গায়ে একটা ফুলের টোকা পর্যন্ত দেই নাই। অথচ তারেই ক্যামনে গুলি কইরা মারল।’

প্রতিবেশীদের কয়েকজন বলেন, ১৮ জুলাই সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ তাঁরা খবর পান, রাহাত গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। তার মরদেহ পড়ে আছে উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। খবরটি শোনার পর অচেতন হয়ে পড়েন মা স্বপ্না। পরে প্রতিবেশীরাই উদ্যোগ নিয়ে রাহাতের মরদেহ আনার ব্যবস্থা করেন। এরপর গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে রাহাতকে দাফন করা হয়।

সেদিন লাশ আনতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী যুবক মো. আল-আমিন। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাহাতের মাথার বাঁ পাশে একটি গুলি লাগে। সেটি মাথার ভেতরেই থেকে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পরপর তাকে আইসিউতে রাখা হয়। কিন্তু এর মধ্যেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে মারা যায়।’

সরকারের কাছে ছেলেকে ফেরত চেয়ে স্বপ্না বলেন, ‘এহন বিচার চাইলে আমার ছেলেরে ফেরত দিতে হইবো। তারা (সরকার) তো কোডা (কোটা) ফেরত দিছে, এবার তাইলে আমার ছেলেরে ফেরত দেক। কোডা দিসে, আন্দোলন থাইম্যা গেছে, দেশও ঠান্ডা হইসে, কিন্তু আমি ছেলে পামু কই?’

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

‘কীই–বা অপরাধ করেছে যে ছেলেরে গুলি করে মারতে হইলো,’ প্রশ্ন মায়ের

আপডেট সময় : ১২:২৬:২৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ জুলাই ২০২৪

রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে গুলিতে শিক্ষার্থী আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনাটি বারবার মুঠোফোনে দেখছিল রাহাত হোসাইন (১৭)। এটি দেখে ভীষণ মন খারাপ করছিল সে। ১৭ জুলাই ভিডিওটি মা স্বপ্না আক্তারকে দেখিয়ে সে বলছিল, ‘দেখো, মা! পুলিশ ক্যামনে ছাত্রগোরে মারে।’ এর মাত্র এক দিন পর ১৮ জুলাই বিকেলে একই আন্দোলনে গিয়ে লাশ হয়ে ফেরে রাহাতও।

ঘটনাটি বর্ণনার এই পর্যায়ে আক্ষেপের সুরে স্বপ্না বলছিলেন, ‘ছেলে আন্দোলনে যাইবো, এইড্যা জানলে আমি কোনো দিনও ওরে হাতছাড়া করতাম না। জানলে নিজে লগে যাইতাম, গুলি খাইলে মা-ছেলে একলগেই খাইতাম।’

রাহাত হোসাইন উত্তরার নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল। পোশাকশ্রমিক মা ও নানির সঙ্গে থাকত গাজীপুরের টঙ্গী এলাকার গোপালপুরে। পরিবারের সচ্ছলতার জন্য বাবা পাড়ি জমিয়েছেন ভিনদেশে। রাহাতের পরিবারের দাবি, ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় সে।

মৃত্যুর ১১ দিন পর গত রোববার দুপুরে রাহাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাকে হারানোর শোকে কাতর পুরো পরিবার। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে দিশাহারা মা স্বপ্না আক্তার। বাড়িতে গিয়ে নিজ ঘরেই পাওয়া গেল তাঁকে। দুই দিন আগে নিজেদের বাড়ি নরসিংদীতে রাহাতের দাফন শেষে আবার টঙ্গীতে ফিরেছেন। ছোট্ট ঘরটিতে একটি বিছানা, ওয়ার্ডরোব, পড়ার টেবিল আর কিছু দরকারি জিনিসপত্র। এসবের মধ্যে ছড়িয়ে আছে রাহাতের ব্যবহৃত বই-খাতা আর দেয়ালে কিছু কাপড় ও স্কুলব্যাগ। এগুলোর দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন স্বপ্না আক্তার। ছেলের কথা মনে পড়তেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন।

আমার একটামাত্র ছেলে। ভাবছিলাম, একটারেই ঠিকমতো লেখাপড়া শিখাইয়্যা বড় করমু। সে আমাগোর অভাবের সংসারে হাল ধরব। কিন্তু এহন তো আমার সব শেষ! এহন আমি কই যামু।’ কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন নিহত রাহাতের মা।

রাহাতের বাড়িতে এই প্রতিবেদকের যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীরাও এক এক করে ভিড় জমান সেখানে। স্বপ্নাকে কাঁদতে দেখে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন কেউ কেউ, কেউ আবার নিজেরাও কাঁদছিলেন। এর মধ্যে এক প্রতিবেশী যুবক মুঠোফোনে রাহাতের লাশের ছবি বের করেন। এতে দেখা যায়, রাহাতের মাথার বাঁ পাশে গুলির ক্ষতচিহ্ন। পুরো মাথা ও শরীর রক্তে ভেজা। ওই অবস্থায় পড়ে আছে হাসপাতালের মেঝেতে।

প্রতিবেশীদের কয়েকজন বলেন, ১৮ জুলাই সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ তাঁরা খবর পান, রাহাত গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। তার মরদেহ পড়ে আছে উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। খবরটি শোনার পর অচেতন হয়ে পড়েন মা স্বপ্না। পরে প্রতিবেশীরাই উদ্যোগ নিয়ে রাহাতের মরদেহ আনার ব্যবস্থা করেন।

স্বপ্না মুঠোফোনটি নিজের হাতে নেন। ছবিটি দেখিয়ে বললেন, ‘এভাবে কেউ মানুষ মারে! ওর কী এমন বয়স হইসে, কীই–বা অপরাধ করেছে যে ছেলেরে গুলি করে মারতে হইলো? একটাবার দেহেন, মরার আগে আমার বাজানটার (ছেলে) কত কষ্ট হইসে। কষ্ট পাইবো দেইখ্যা নিজেরা কোনো দিন ওর গায়ে একটা ফুলের টোকা পর্যন্ত দেই নাই। অথচ তারেই ক্যামনে গুলি কইরা মারল।’

প্রতিবেশীদের কয়েকজন বলেন, ১৮ জুলাই সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ তাঁরা খবর পান, রাহাত গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে। তার মরদেহ পড়ে আছে উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। খবরটি শোনার পর অচেতন হয়ে পড়েন মা স্বপ্না। পরে প্রতিবেশীরাই উদ্যোগ নিয়ে রাহাতের মরদেহ আনার ব্যবস্থা করেন। এরপর গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে রাহাতকে দাফন করা হয়।

সেদিন লাশ আনতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী যুবক মো. আল-আমিন। চিকিৎসকের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাহাতের মাথার বাঁ পাশে একটি গুলি লাগে। সেটি মাথার ভেতরেই থেকে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পরপর তাকে আইসিউতে রাখা হয়। কিন্তু এর মধ্যেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে সে মারা যায়।’

সরকারের কাছে ছেলেকে ফেরত চেয়ে স্বপ্না বলেন, ‘এহন বিচার চাইলে আমার ছেলেরে ফেরত দিতে হইবো। তারা (সরকার) তো কোডা (কোটা) ফেরত দিছে, এবার তাইলে আমার ছেলেরে ফেরত দেক। কোডা দিসে, আন্দোলন থাইম্যা গেছে, দেশও ঠান্ডা হইসে, কিন্তু আমি ছেলে পামু কই?’