ঢাকা ০১:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গাজীপুরের শিল্প এলাকায় পাওনা না পেয়ে বারবার সড়কে নামছেন শ্রমিকেরা

অপরাধ দৃষ্টি নিউজ
  • আপডেট সময় : ১১:৫৫:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪
  • / 84
অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গাজীপুরের শিল্পকারখানাগুলোয় শ্রমিক অসন্তোষ থামছেই না। বিভিন্ন দাবি নিয়ে বারবার মহাসড়ক আটকে দিচ্ছেন শ্রমিকেরা। গত তিন মাসে অন্তত ২৫ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। কয়েক দিন পরপর অবরোধের কারণে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়ছেন এসব পথে চলাচলকারী হাজারো যানবাহনের যাত্রীরা।

সর্বশেষ বকেয়া বেতন আদায় করতে গত শনিবার সকাল নয়টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার সহস্রাধিক শ্রমিক। টানা ৫২ ঘণ্টা পর গতকাল সোমবার দুপুরে শ্রমিকেরা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। তবে দুই ঘণ্টা পর বিকেল চারটার দিকে আবারও তাঁরা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন। আগামী রোববারের মধ্যে বকেয়া বেতন পরিশোধের আশ্বাসে রাত সোয়া ১০টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন শ্রমিকেরা। এর আগে নগরীর মালেকের বাড়ি এলাকায় এ অবরোধের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সড়কটিতে চলাচলকারী মানুষেরা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আশপাশের মোট ১২টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গাজীপুরে গত তিন মাসে অন্তত ২৫ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে।

বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন কয়েক শ শ্রমিক। ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের মালেকের বাড়ি এলাকায়।
বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন কয়েক শ শ্রমিক। ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের মালেকের বাড়ি এলাকায়।ফাইল ছবি:

সড়কে কেন আন্দোলন করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার শ্রমিক মো. সুলতান উদ্দিন বলেন, ‘হোনেন, দেশের কোনো আন্দোলনই সড়কে না করলে ফল পাওয়া যায় না। আমরা সড়ক বন্ধ করছি আপনারা দেখাইতেছেন, ওপরের অফিসারও দেখতাছে। এহন দেখবেন ঠিকই একটা সমাধান হবে।’ সড়ক কখন ছেড়ে দেবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ না বেতন পামু, ততক্ষণ ছাড়তাছি না। খাইয়া না–খাইয়া এইবার নামছি। বেতন নিয়াই বাড়িতে যামু।’

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহায়ক কমিটির সদস্য আ ন ম সাইফুদ্দিন  বলেন, টিএনজেড কারখানার মালিক বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। তাঁর যে পরিমাণ সম্পদ এবং ঋণ রয়েছে সেটা সমন্বয় করেও শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের মতো পরিস্থিতি নেই। তারপরও তিনি দেশে থাকলে বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা যেত। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিজিএমইএর বর্তমান প্রশাসক কাজ করছেন। তবে কমিটি না থাকার কারণে আগে যেভাবে করা যেত সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গাজীপুরে গত তিন মাসে অন্তত ২৫ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে। অবরোধ ছাড়াও অনেক স্থানে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন। তবে সেগুলো কারখানা এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময়ে জেলায় অন্তত ৪০টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বলে শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি শিল্পকারখানা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে শ্রীপুরের বাঘেরবাজার এলাকা পর্যন্ত। এ মহাসড়কে গত তিন মাসে ১৯ থেকে ২০ বার অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সমাধান হয়েছে।

গাজীপুরের সারাবো এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকেরা চার–পাঁচ দিন সড়ক অবরোধ করে বেতনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। জিরানী এলাকার রেডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল ও আইরিশ ফ্যাশন কারখানার শ্রমিকেরা হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল ও নাইট বিল বৃদ্ধির দাবিতে অন্তত চার দিন চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এসব এলাকায় শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপে কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবিদাওয়া মেনে নিলে পরিবেশ শান্ত হয়। অপর দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন কোনাবাড়ী তুসুকা গ্রুপের ছয়টি কারখানা, ইসলাম গার্মেন্টস লিমিটেড, রেজাউল অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফ্যাশন সুমিট লিমিটেড, কেএম নোভেলি লিমিটেড, ফ্যাশন পয়েন্ট, রিপন নিটওয়্যার, লাইফট্যাক্স লিমিটেড, কানিজ ফ্যাশন, এবিএম ফ্যাশন লিমিটেড, পিএন কম্পোজিট, মুকুল নিটওয়্যার, কটন ক্লাব, এ্যামা সিনট্যাক্স, বেসিক ক্লোথিং ও অ্যাপারেল প্লাসের শ্রমিকেরা। চন্দ্রা এলাকায় মাহমুদ জিনস ও নূরুল স্পিনিং কারখানার শ্রমিকেরাও বিক্ষোভ করেছেন সড়ক অবরোধ করে। এ ছাড়া পানিশাইল এলাকার ডরিন ফ্যাশন, চন্দ্রা এলাকার মাহমুদ জিনস, নূরুল ইসলাম স্পিনিংয়ের শ্রমিকেরা নানা দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন।

গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি শিল্পকারখানা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে শ্রীপুরের বাঘেরবাজার এলাকা পর্যন্ত। এ মহাসড়কে গত তিন মাসে ১৯ থেকে ২০ বার অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সমাধান হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজীপুর শিল্প পুলিশের একজন পরিদর্শক বলেন, ‘মালিকেরা যখন বেতন দেন না বা শ্রমিকদের নির্যাতন করেন, তখন তাঁরা দূরে কোথাও না গিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এতে প্রশাসনের লোকজন নড়েচড়ে বসেন। আমরাও সড়ক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কারখানা কর্তৃপক্ষকে চাপ সৃষ্টি করি। এতে সহজেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’

আশুলিয়া আর গাজীপুর মিলে ৮ থেকে ১০টি কারখানায় মূলত ঝামেলা দেখছি। তাদের পাওনাও খুব বেশি না। প্রয়োজনে ওই সব মালিকদের কিছু সম্পদ বিক্রি করে হলেও পাওনা পরিশোধ করুক। মূলত শ্রমিকেরা মনে করে একমাত্র রাস্তা অবরোধ করে রাখলেই দাবি আদায় হবে। এই ধারণাটা পাল্টাতে হবে।

শ্রমিকনেতা আরমান হোসাইন

শিল্প পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বেতন বাড়ানোর ঘোষণাও আসে। তবে বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি কারখানা কর্তৃপক্ষ খরচ কমানোর জন্য ধীরে ধীরে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করে। ছাঁটাই শ্রমিকেরা পরে আর চাকরি ফিরে পাননি। আবার নতুন করে চাকরি নিতে গিয়ে দেখেন বেতন আগের চেয়ে কম পাচ্ছেন। যার কারণে তাঁরাও আর চাকরিতে ফিরতে পারেননি। সরকার পরিবর্তনের পর তাঁরাই কারখানাগুলোয় জড়ো হয়েছেন চাকরি ফিরে পেতে। আবার কিছু কারখানায় নতুন নতুন দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন হচ্ছে। দাবি আদায় করতে শ্রমিকেরা অবরোধ করছেন মহাসড়ক। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।

শ্রমিকনেতা আরমান হোসাইন বলেন, ‘আশুলিয়া আর গাজীপুর মিলে ৮ থেকে ১০টি কারখানায় মূলত ঝামেলা দেখছি। তাদের পাওনাও খুব বেশি না। প্রয়োজনে ওই সব মালিকদের কিছু সম্পদ বিক্রি করে হলেও পাওনা পরিশোধ করুক। মূলত শ্রমিকেরা মনে করে একমাত্র রাস্তা অবরোধ করে রাখলেই দাবি আদায় হবে। এই ধারণাটা পাল্টাতে হবে।’

অবরোধের কারণে প্রায়ই দুর্ভোগে পড়ছেন গাজীপুরের বলাকা পরিবহনের চালক সুলতান মিয়া। তিনি  বলেন, ‘গাড়ি চালাই ১০ থেকে ১২ বছর ধরে। কখনোই শান্তিমতো গাড়ি চালাতে পারলাম না। নানা কারণে শ্রমিকেরা রাস্তায় নামছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করছে। এতে আমাদেরও আয় কমছে, মালিকদেরও লোকসানে পড়তে হচ্ছে।’

গাজীপুরে একেক সময় একেক কারণে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করছেন উল্লেখ করে শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম  বলেন, ‘আমারও একই প্রশ্ন, বেতনের দাবিতে সড়ক কেন অবরোধ করে তারা? শ্রমিকেরা ইচ্ছা করলে বিজিএমইএর ভবনে যেতে পারে। কারখানায় আন্দোলন করতে পারে। হাজার হাজার মানুষকে কষ্ট দিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখা ঠিক হচ্ছে না।’

গাজীপুরে বেশির ভাগ কারখানায় বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে শ্রমিকদের একটা দূরত্ব ছিল। দাবির বিষয়ে কথা বলতে শ্রমিকেরা সেই সময় ভয় পেতেন। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন বলে মনে করেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান। তিনি বলেন, সড়ক অবরোধ করলেই সবার টনক নড়ে, সমস্যার সমাধানও হয়। শ্রমিকেরা বিজিএমইএর ভবনে গিয়েও কোনো সুরাহা পাননি। তাই বাধ্য হয়েই শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়।

আমারও একই প্রশ্ন, বেতনের দাবিতে সড়ক কেন অবরোধ করে তারা? শ্রমিকেরা ইচ্ছা করলে বিজিএমইএর ভবনে যেতে পারে। কারখানায় আন্দোলন করতে পারে। হাজার হাজার মানুষকে কষ্ট দিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখা ঠিক হচ্ছে না।

শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

গাজীপুরের শিল্প এলাকায় পাওনা না পেয়ে বারবার সড়কে নামছেন শ্রমিকেরা

আপডেট সময় : ১১:৫৫:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪

গাজীপুরের শিল্পকারখানাগুলোয় শ্রমিক অসন্তোষ থামছেই না। বিভিন্ন দাবি নিয়ে বারবার মহাসড়ক আটকে দিচ্ছেন শ্রমিকেরা। গত তিন মাসে অন্তত ২৫ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। কয়েক দিন পরপর অবরোধের কারণে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়ছেন এসব পথে চলাচলকারী হাজারো যানবাহনের যাত্রীরা।

সর্বশেষ বকেয়া বেতন আদায় করতে গত শনিবার সকাল নয়টা থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার সহস্রাধিক শ্রমিক। টানা ৫২ ঘণ্টা পর গতকাল সোমবার দুপুরে শ্রমিকেরা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন। তবে দুই ঘণ্টা পর বিকেল চারটার দিকে আবারও তাঁরা মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেন। আগামী রোববারের মধ্যে বকেয়া বেতন পরিশোধের আশ্বাসে রাত সোয়া ১০টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন শ্রমিকেরা। এর আগে নগরীর মালেকের বাড়ি এলাকায় এ অবরোধের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সড়কটিতে চলাচলকারী মানুষেরা। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আশপাশের মোট ১২টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গাজীপুরে গত তিন মাসে অন্তত ২৫ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে।

বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন কয়েক শ শ্রমিক। ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের মালেকের বাড়ি এলাকায়।
বেতনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন কয়েক শ শ্রমিক। ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কের মালেকের বাড়ি এলাকায়।ফাইল ছবি:

সড়কে কেন আন্দোলন করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার শ্রমিক মো. সুলতান উদ্দিন বলেন, ‘হোনেন, দেশের কোনো আন্দোলনই সড়কে না করলে ফল পাওয়া যায় না। আমরা সড়ক বন্ধ করছি আপনারা দেখাইতেছেন, ওপরের অফিসারও দেখতাছে। এহন দেখবেন ঠিকই একটা সমাধান হবে।’ সড়ক কখন ছেড়ে দেবেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যতক্ষণ না বেতন পামু, ততক্ষণ ছাড়তাছি না। খাইয়া না–খাইয়া এইবার নামছি। বেতন নিয়াই বাড়িতে যামু।’

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহায়ক কমিটির সদস্য আ ন ম সাইফুদ্দিন  বলেন, টিএনজেড কারখানার মালিক বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। তাঁর যে পরিমাণ সম্পদ এবং ঋণ রয়েছে সেটা সমন্বয় করেও শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের মতো পরিস্থিতি নেই। তারপরও তিনি দেশে থাকলে বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা যেত। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিজিএমইএর বর্তমান প্রশাসক কাজ করছেন। তবে কমিটি না থাকার কারণে আগে যেভাবে করা যেত সেভাবে সম্ভব হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গাজীপুরে গত তিন মাসে অন্তত ২৫ বার ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-নবীনগর মহাসড়ক অবরোধ করা হয়েছে। অবরোধ ছাড়াও অনেক স্থানে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন। তবে সেগুলো কারখানা এলাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই সময়ে জেলায় অন্তত ৪০টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে বলে শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি শিল্পকারখানা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে শ্রীপুরের বাঘেরবাজার এলাকা পর্যন্ত। এ মহাসড়কে গত তিন মাসে ১৯ থেকে ২০ বার অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সমাধান হয়েছে।

গাজীপুরের সারাবো এলাকার বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের শ্রমিকেরা চার–পাঁচ দিন সড়ক অবরোধ করে বেতনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। জিরানী এলাকার রেডিয়াল ইন্টারন্যাশনাল ও আইরিশ ফ্যাশন কারখানার শ্রমিকেরা হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল ও নাইট বিল বৃদ্ধির দাবিতে অন্তত চার দিন চন্দ্রা-নবীনগর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এসব এলাকায় শিল্প পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের হস্তক্ষেপে কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবিদাওয়া মেনে নিলে পরিবেশ শান্ত হয়। অপর দিকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন কোনাবাড়ী তুসুকা গ্রুপের ছয়টি কারখানা, ইসলাম গার্মেন্টস লিমিটেড, রেজাউল অ্যাপারেলস লিমিটেড, ফ্যাশন সুমিট লিমিটেড, কেএম নোভেলি লিমিটেড, ফ্যাশন পয়েন্ট, রিপন নিটওয়্যার, লাইফট্যাক্স লিমিটেড, কানিজ ফ্যাশন, এবিএম ফ্যাশন লিমিটেড, পিএন কম্পোজিট, মুকুল নিটওয়্যার, কটন ক্লাব, এ্যামা সিনট্যাক্স, বেসিক ক্লোথিং ও অ্যাপারেল প্লাসের শ্রমিকেরা। চন্দ্রা এলাকায় মাহমুদ জিনস ও নূরুল স্পিনিং কারখানার শ্রমিকেরাও বিক্ষোভ করেছেন সড়ক অবরোধ করে। এ ছাড়া পানিশাইল এলাকার ডরিন ফ্যাশন, চন্দ্রা এলাকার মাহমুদ জিনস, নূরুল ইসলাম স্পিনিংয়ের শ্রমিকেরা নানা দাবিতে রাস্তায় নেমেছিলেন।

গাজীপুরে সবচেয়ে বেশি শিল্পকারখানা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে শ্রীপুরের বাঘেরবাজার এলাকা পর্যন্ত। এ মহাসড়কে গত তিন মাসে ১৯ থেকে ২০ বার অবরোধের ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সমাধান হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাজীপুর শিল্প পুলিশের একজন পরিদর্শক বলেন, ‘মালিকেরা যখন বেতন দেন না বা শ্রমিকদের নির্যাতন করেন, তখন তাঁরা দূরে কোথাও না গিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এতে প্রশাসনের লোকজন নড়েচড়ে বসেন। আমরাও সড়ক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কারখানা কর্তৃপক্ষকে চাপ সৃষ্টি করি। এতে সহজেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।’

আশুলিয়া আর গাজীপুর মিলে ৮ থেকে ১০টি কারখানায় মূলত ঝামেলা দেখছি। তাদের পাওনাও খুব বেশি না। প্রয়োজনে ওই সব মালিকদের কিছু সম্পদ বিক্রি করে হলেও পাওনা পরিশোধ করুক। মূলত শ্রমিকেরা মনে করে একমাত্র রাস্তা অবরোধ করে রাখলেই দাবি আদায় হবে। এই ধারণাটা পাল্টাতে হবে।

শ্রমিকনেতা আরমান হোসাইন

শিল্প পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দা ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁদের বেতন বাড়ানোর ঘোষণাও আসে। তবে বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি কারখানা কর্তৃপক্ষ খরচ কমানোর জন্য ধীরে ধীরে শ্রমিক ছাঁটাই শুরু করে। ছাঁটাই শ্রমিকেরা পরে আর চাকরি ফিরে পাননি। আবার নতুন করে চাকরি নিতে গিয়ে দেখেন বেতন আগের চেয়ে কম পাচ্ছেন। যার কারণে তাঁরাও আর চাকরিতে ফিরতে পারেননি। সরকার পরিবর্তনের পর তাঁরাই কারখানাগুলোয় জড়ো হয়েছেন চাকরি ফিরে পেতে। আবার কিছু কারখানায় নতুন নতুন দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন হচ্ছে। দাবি আদায় করতে শ্রমিকেরা অবরোধ করছেন মহাসড়ক। এতে দুর্ভোগে পড়ছেন সাধারণ মানুষ।

শ্রমিকনেতা আরমান হোসাইন বলেন, ‘আশুলিয়া আর গাজীপুর মিলে ৮ থেকে ১০টি কারখানায় মূলত ঝামেলা দেখছি। তাদের পাওনাও খুব বেশি না। প্রয়োজনে ওই সব মালিকদের কিছু সম্পদ বিক্রি করে হলেও পাওনা পরিশোধ করুক। মূলত শ্রমিকেরা মনে করে একমাত্র রাস্তা অবরোধ করে রাখলেই দাবি আদায় হবে। এই ধারণাটা পাল্টাতে হবে।’

অবরোধের কারণে প্রায়ই দুর্ভোগে পড়ছেন গাজীপুরের বলাকা পরিবহনের চালক সুলতান মিয়া। তিনি  বলেন, ‘গাড়ি চালাই ১০ থেকে ১২ বছর ধরে। কখনোই শান্তিমতো গাড়ি চালাতে পারলাম না। নানা কারণে শ্রমিকেরা রাস্তায় নামছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করছে। এতে আমাদেরও আয় কমছে, মালিকদেরও লোকসানে পড়তে হচ্ছে।’

গাজীপুরে একেক সময় একেক কারণে শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করছেন উল্লেখ করে শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম  বলেন, ‘আমারও একই প্রশ্ন, বেতনের দাবিতে সড়ক কেন অবরোধ করে তারা? শ্রমিকেরা ইচ্ছা করলে বিজিএমইএর ভবনে যেতে পারে। কারখানায় আন্দোলন করতে পারে। হাজার হাজার মানুষকে কষ্ট দিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখা ঠিক হচ্ছে না।’

গাজীপুরে বেশির ভাগ কারখানায় বড় কর্মকর্তাদের সঙ্গে শ্রমিকদের একটা দূরত্ব ছিল। দাবির বিষয়ে কথা বলতে শ্রমিকেরা সেই সময় ভয় পেতেন। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন বলে মনে করেন জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোটের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান। তিনি বলেন, সড়ক অবরোধ করলেই সবার টনক নড়ে, সমস্যার সমাধানও হয়। শ্রমিকেরা বিজিএমইএর ভবনে গিয়েও কোনো সুরাহা পাননি। তাই বাধ্য হয়েই শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়।

আমারও একই প্রশ্ন, বেতনের দাবিতে সড়ক কেন অবরোধ করে তারা? শ্রমিকেরা ইচ্ছা করলে বিজিএমইএর ভবনে যেতে পারে। কারখানায় আন্দোলন করতে পারে। হাজার হাজার মানুষকে কষ্ট দিয়ে সড়ক অবরোধ করে রাখা ঠিক হচ্ছে না।

শিল্পাঞ্চলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম